ফেসবুকের আগামী দশ বছরের পরিকল্পনা তুলে ধরলেন মার্ক জাকারবার্গ ।
আমেরিকার সান ফ্রান্সিসকো শহরে ফেসবুকের এফ৮ কনফারেন্সে ১২ এপ্রিল ২০১৬ তারিখে মার্ক জাকারবার্গ আগামী ১০ বছরের পরিকল্পনা সবার সামনে তুলে ধরেন। প্রযুক্তিখাতে এভাবে নিজস্ব পরিকল্পনা সবার সামনে একেবারে খোলামেলাভাবে তুলের ধরার রেওয়াজ নেই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যা থাকে, তা হলো তাদের পণ্যের গুণগান। গুগল, ইন্টেল, মাইক্রোসফট, সিসকো, ওরাকল, যার কথাই বলি না কেন, হাইটেক কোম্পানিগুলো মূলত এই ধরনের কনফারেন্সে নিজেদের গুণগানই গেয়ে থাকে। খুব বেশি হলে আগামী বছর বাজারে কী আসতে পারে, সেই বিষয়ে একটু ধারণা দেওয়া হয়ে থাকে। আর এ্যাপলের মতো কোম্পানি তো সব কিছুই গোপন রাখে। তারা কখনই তাদের রোডম্যাপ অন্যকে জানায় না। সেই দিক থেকে মার্ক জাকারবার্গ খুবই ব্যতিক্রমধর্মী একটি কাজ করেছেন। তবে তিনি পুরো বিশ্বকে একটি ঝাঁকুনি দিতে চেয়েছেন। আর তাই হয়তো এভাবে খোলামেলা সবকিছু শেয়ার করেছেন।
একটি বিশাল ঝাঁকুনি দেওয়ার মতো ক্ষমতা আছে বলেই, ৩১ বছরের এই যুবক এখন সবার আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বের অনেকের মতো আমিও তার বক্তৃতা মুগ্ধ হয়ে শুনলাম। প্রতিটি মিনিটে নতুন যে বিষয়গুলো তিনি তুলে ধরেছেন, আমি নিশ্চিত এটা যেকোনোও প্রযুক্তিপ্রেমী মানুষকে আকৃষ্ট করবে। আমরা যেগুলো বিজ্ঞানকল্প কাহিনীতে পড়তাম, কিংবা লিখতাম- সেগুলোই এখন বাস্তবে রূপ নিতে যাচ্ছে। পুরো বিশ্বের মিডিয়া এটা নিয়ে কথা বলছে। ৩০ মিনিটের সেই বক্তৃতায় বুঝা গেছে যে, মার্ক জাকারবার্গ তার জীবনের সবচেয়ে বড় খেলাটি খেলতে যাচ্ছেন। চলুন দেখা যাক, কেন মানুষ তার বক্তৃতা এবং পরিকল্পনাকে এতটা প্রাধান্য দিচ্ছে। যেকোনোও প্রযুক্তিপ্রেমী মানুষের জন্য বিষয়গুলো জানা থাকলে আগামী দিনগুলোর বেশ মজার হয়ে উঠতে পারে।
১. চ্যাট করার রোবট
আমরা এত দিন কোনোও মানুষের সাথে চ্যাট করতে অভ্যস্ত ছিলাম। কিন্তু এখন ফেসবুক তাদের ম্যাসেঞ্জারে নিয়ে এসেছে রোবট। অর্থাৎ একটি রোবট আপনার সঙ্গে কথা বলবে। এই প্রযুক্তিটি ইতোমধ্যেই সিএনএন এবং ১-৮০০-ফ্লাওয়ার (টেলিফোনের মাধ্যমে ফুল অর্ডার করার দোকান) পরীক্ষামূলকভাবে পরিচালনা করছে। ফুল বিক্রির দোকানটি আমেরিকায় খুবই জনপ্রিয়। প্রথমে তারা টেলিফোনের মাধ্যমে অর্ডার নিত। তারপর ইন্টারনেটে ওয়েবসাইটের মাধ্যমেও অর্ডার করা যেত। কিন্তু এখন সরাসরি ম্যাসেঞ্জারের মাধ্যমেই ফুল অর্ডার করা যাবে। আপনি কাকে ফুল পাঠাতে চান, তার নাম এবং বিষয়াদি লিখে দিলেই রোবটটি আপনার অর্ডারটি নিয়ে ফেলবে। ব্যাপারটি অনেকটা এমন যে, ম্যাসেঞ্জারকে বললেন ওই জুতাটা নিয়ে এসো। ব্যাস, কেনা হয়ে গেল। আমাদের বাড়ির ফরমায়েস খাটা মানুষটার মতো।
পাশাপাশি সিএনএন আরেকটি মজার বিষয় করছে। আপনি কোনোও একটি রিপোর্টের উপর নানান প্রশ্ন করতে পারেন। সেগুলোর উত্তর দিয়ে দেবে ওই রোবট। আপনার কাছে মনে হবে, আপনি একজন রিপোর্টারকে কোনোও প্রশ্ন করছেন। কিন্তু একটি রোবট আপনাকে ইচ্ছেমতো তথ্য দিয়ে সহায়তা করবে। আমাদের প্রচলিত সাংবাদিকতা যে আরও পাল্টে যাবে, তাতে কোনোও সন্দেহ নেই।
এখানে আরেকটি তথ্য সবার কাজে লাগতে পারে। বর্তমানে প্রতিদিন প্রায় ৬০ বিলিয়ন ম্যাসেজ আদান প্রদান করে ফেসবুক ম্যাসেঞ্জার এবং হোয়াটসঅ্যাপ। কিন্তু পুরো পৃথিবীতে সকল মোবাইল অপারেটর মিলে সারাদিনে মাত্র ২০ বিলিয়ন ম্যাসেজ আদান প্রদান করে থাকে। এটা থেকে কেউ কেউ মোবাইল কোম্পানিগুলোর ভবিষ্যৎ অনুমান করতে পারেন।
২. বিজ্ঞাপনী ম্যাসেজ
এত দিন ফেসবুক ম্যাসেঞ্জার কাউকে কোনোও পণ্যের বিজ্ঞাপন পাঠাতে পারত না। বিজ্ঞাপন থাকত পেজের ডান দিকে, নয়তো স্পন্সরড নিউজ ফিডে। কিন্তু এখন কোনোও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান চাইলে তাদের পণ্যের জন্য সরাসরি ম্যাসেজ পাঠাতে পারবে; এবং পণ্যটিকে প্রোমোট করতে পারবে। বিষয়টা হয়তো অনেকটা এমন হবে যে, আমরা নিত্যদিন এসএমএস-এ যেরকম বিভিন্ন অফার পেয়ে থাকি, এটা হবে নতুন দিনের উৎপাত। তবে এসএমএস হলো একমুখী প্রচারণা। মেসেঞ্জারে কোনোও ম্যাসেজ পাঠিয়ে গ্রাহক ধরাটা অনেকটা সহজ হবে, কারণ এটা হবে দুইমুখী প্রচারণা। আপনি ম্যাসেজটি পড়েছেন, সেটাও সে দেখতে পাবে। এবং চাইলে আপনার সাথে যোগাযোগ রাখতে পারবে। তবে সুখের বিষয় এই যে, যারা এই ধরনের পণ্যের ম্যাসেজ পেতে চান সেই ব্যবহারকারীদের ফোন নম্বর বিজ্ঞাপনী সংস্থার কাছে থাকতে হবে।
৩. স্যাটেলাইট এবং ইন্টারনেট উড়োজাহাজ
এই মুহূর্তে পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি মানুষের কাছে ইন্টারনেট নেই। প্রায় ২০০ কোটি মানুষের কাছে ইন্টারনেট পৌঁছানোর মাধ্যম নেই। আর ১০০ কোটি মানুষের ইন্টারনেট ব্যবহারের সাধ্য নেই। আর আরও ১০০ কোটি মানুষের জানে না কেন তারা ইন্টারনেট ব্যবহার করবে। এই প্রায় ৪০০ কোটি মানুষকে ইন্টারনেটের আওতায় আনার কাজটি করতে যাচ্ছে ফেসবুক।
আর সেই লক্ষ্যে তিনি তৈরি করছেন স্যাটেলাইট এবং উড়োজাহাজ। তিনি তার বক্তৃতার সময় বিশাল পাখাযুক্ত একটি উড়োজাহাজ তৈরির কারখানার ছবি দেখান। তিনি হাসতে হাসতে বলছিলেন, আমি যদি ১২ বছর আগে বলতাম আমি একটি উড়োজাহাজ বানাব, তাহলে সবাই আমার কথা শুনে নিশ্চই হাসত। কিন্তু এখন আমি সত্যি সত্যিই উড়োজাহাজ তৈরি করতে যাচ্ছি।
এটা মূলত তার ইন্টারনেট.অর্গ-এর কর্মকাণ্ডের অংশ হিসেবে করা। আফ্রিকার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়ার জন্য এই মহাপরিকল্পনা। বিশ্বের ৩৭টি দেশে বিনামূল্যের এই ইন্টারনেট কার্যক্রম চলছে। সঙ্গে সহযোগী হিসেবে নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন দেশের মোবাইল অপারেটরদেরকে। বাংলাদেশেও বর্তমানে ইন্টারনেট.অর্গের অপারেশন বিদ্যমান। তবে ভারতে সম্প্রতি এই কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে সেই দেশের সরকার।
৪. ভার্চুয়াল রিয়ালিটি
ফেসবুক অনেক দিন ধরেই ভার্চুয়াল রিয়েলিটি নিয়ে কাজ করছিল। তারই উন্মুক্ত ডেমো করলেন মার্ক জাকারবার্গ। তিনি মনে করেন, মানুষ অনেক বেশি সময় ব্যয় করবে ভার্চুয়াল জগতে। সেখানে তারা খেলবে, দেখা করবে, ভাব বিনিময় করবে। এবং এই অভিজ্ঞতাগুলো আর ছবি দেখার মতো হবে না। সেগুলো হবে জীবন্ত মানুষের অভিজ্ঞতার মতো; আমাদের সাধারণ জীবনের মতো।
একটু চোখ বন্ধ করে ভাবা যেতে পারে, আপনি একজন মানুষের সঙ্গে টেবিল টেনিস খেলছেন যিনি বসে আছেন পৃথিবীর আরেক প্রান্তে নিউ ইয়র্ক কিংবা স্যান ফ্রান্সিসকোতে। আপনি একটি সিনেমা দেখছেন ইন্টারনেটে। সেই সিনেমাটি এমন হবে যেন আপনি সত্যি সত্যি সিনেমার ভেতর ঢুকে গেছেন। আপনি হয়ে গেছেন সেই মুভির একটি অংশ। সাগরতলায় কিংবা পাহাড়ের চূড়ায় নয় তো স্বপ্নিল রুপালি সুমদ্রের বালুময় তীরে। সেই অভিজ্ঞতা আপনি নিতে পারবেন ঘরে বসেই।
আপনি একটি আর্টিকেল পড়ছেন। সেটা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আপনি যদি ওটার অভিজ্ঞতা নিতে চান, তাহলে কেমন হবে? ধরুন একটি ভ্রমণ কাহিনী, যা আপনাকে দেবে লেখকের মতোই সমান অভিজ্ঞতা।
উল্লেখ্য যে, অনুষ্ঠানে যারা অংশ নিয়েছেন তারা সবাই একটি করে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ডিভাইস এবং স্যামসাং স্মার্টফোন উপহার হিসেবে পেয়েছেন। ৬০০ ডলারের টিকিট কেটে ৮০০ ডলারের উপহার পাওয়া মন্দ নয়!
৫. ৩৬০ ডিগ্রি ক্যামেরা
ফেসবুক নতুন একটি ক্যামেরা তৈরি করেছে, যা ৩৬০ ডিগ্রি কভার করে ছবি তুলতে পারে। এর নাম দেওয়া হয়েছে ফেসবুক সারাউন্ড ৩৬০। এর ভেতর রয়েছে ১৪টি ক্যামেরা যা দিয়ে চারদিকের ছবি একসাথে তোলা হয় এবং জোড়া দিয়ে একটি চমৎকার ছবি তৈরি করা হয়। মার্ক জাকারবার্গ তার মেয়ের উদাহরণ দিয়ে দেখান যে, যখন নতুন শিশুর জন্ম হলে ছবি তুলে সেটা পরিবারকে দেখানো হতো। তারপর এলো ভিডিও-এর যুগ। বাচ্চার ভিডিও ক্যাপচার করে সেটা পরিবার এবং বন্ধুদের দেখানো হতো। আর এখন এসেছে সারাউন্ড ৩৬০। তিনি তার মেয়ের প্রথম হাঁটার ছবি ভিডিও করেন ওই ক্যামেরা দিয়ে। সেখানে দেখা যায়, পুরো ৩৬০ ডিগ্রি পরিবেশকে ধারণ করেছে ওই ক্যামেরা। চমৎকার এক অনুভূতি।
৬. ফেসবুক লাইভ স্ট্রিমিং
আজকাল ড্রোন খুব জনপ্রিয় হচ্ছে। ই-কমার্স কোম্পানিগুলো ড্রোনের মাধ্যমে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে পণ্য পরিবহন করছে, এমন ছবি আমরা দেখতে পেয়েছি। বাংলাদেশের মতো ট্রাফিক জ্যামের দেশে ড্রোন খুব কাজের একটি জিনিস হতে পারে, যদি না সেই ড্রোন মাঝপথে কেউ ছাদ থেকে টেনে নামিয়ে ফেলে। এবার ভাবুন, যদি সেই ড্রোনের সঙ্গে থাকে ভিডিও ক্যামেরা, তাহলে কেমন হয়?
মার্ক জাকারবার্গ তার বক্তৃতার সময় এমন একটি ড্রোনকে স্টেজে নিয়ে আসেন। সেই ড্রোনের সঙ্গে ছিল লাইভ ক্যামেরা। এর মাধ্যমে তার সেই অনুষ্ঠান সরাসরি লাইভ স্ট্রিমিং করে দেখান। তার পেছনের বড় পর্দায় ভেসে ওঠে সেই ছবি। এগুলো নিয়ে অনেক দিন ধরেই কথা হচ্ছিল। কিন্তু এখন সেটা বাস্তবেও রূপ নিয়েছে।
তিনি আরও জানান যে, এরপর একজন ডেভেলপার ফেসবুক এ্যাপের মাধ্যমে লাইভ ভিডিও সম্প্রচার করতে পারবে। একটি স্মার্টফোন থেকেই সেটা করা সম্ভব হবে। ধরুন কোনোও বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়েছেন, নয়তো কয়েকবন্ধু মিলে কোথাও আড্ডা দিচ্ছেন, নয়তো কোথাও বেড়াতে গিয়েছেন। আপনার লাইভ ভিডিও সম্প্রচার হবে ফেসবুক লাইভে।
৭. মারা যাবে টিভি
টেলিভিশন নিয়ে চিন্তা করেছিলেন স্টিভ জবস। তিনি চাইছিলেন এটাকে পাল্টে দিতে। সেই কাজ তিনি শেষ করে যেতে পারেননি। এখন মার্ক জাকারবার্গ নতুন করে টিভিকে সংজ্ঞায়িত করতে যাচ্ছেন। ফেসবুক তার মোবাইল এ্যাপকে নতুন করে সাজাতে যাচ্ছে, যেখানে শতকরা ২৫ ভাগ কম ডাটা নিয়েই চলতে পারবে। এবং তিনি আশা করছেন ১ ডলারের একটি এ্যাপ এই গ্রহের টিভিকে প্রতিস্থাপিত করে দেবে একদিন।
পারিপার্শিক চিন্তাভাবনা
মার্ক জাকারবার্গ আগামী ১০ বছরের যে পরিকল্পনা এবং ভিশন দেখিয়েছেন, তার মূল ভিত্তি হলো ৩টি- সবাইকে ইন্টারনেটের আওতায় আনা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং ভার্চুয়াল রিয়েলিটি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আগামী দিনের বিশাল একটি জায়গা করে নেবে তাতে কোনোও সন্দেহ নেই। বর্তমান সময়ের সফটওয়্যারগুলো ইতোমধ্যেই বলে দিতে পারে, একটি ছবিতে কে কে আছেন। আপনাকে আর জিজ্ঞেস করতে হয় না। সে মুখ চিনতে পারে। এমন কি অন্ধদেরকে পড়ে শুনাতে পারে। আপনি একটি ছবি তুলেছেন। সেই এ্যাপটি পড়ে শোনাবে, এই ছবিতে রয়েছে সুন্দর একটি দৃশ্য, যেখানে সাগর আর গাছপালা রয়েছে। ছবিটি বিকেলবেলা তোলা হয়েছে। দূরে সমুদ্র তীরে কিছু মানুষ খেলছে। একজন অন্ধ মানুষের জন্য এই তথ্যগুলো কতটা জীবন্ত, যার চোখ নেই তিনি ছাড়া হয়তো আর কেউ তা বলতে পারবেন না।
জাকারবার্গ নিজেও বলেছেন যে, আগামী দিনের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের জীবনকে বাঁচাতে পারে। একটি সিস্টেম বলে দিতে পারবে, ঠিক কেন এবং কোথায় ক্যান্সারটি হয়েছে। কিংবা ক্যান্সার হওয়ার সম্ভবনা কতটুকু। একটি রোবট খুব নিখুঁতভাবে সার্জারি করতে পারবে; কিংবা একজন মুমূর্ষরোগীকে বিশ্বের যেকোনোও বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখানো যাবে এই পৃথিবীর যেকোনোও প্রান্ত থেকে। এগুলো আমরা গল্পের বইতে পড়েছি। কিন্তু এটাকে বাস্তবায়ন করার জন্য শক্তি প্রয়োগ করছেন জাকারবার্গ।
আর ভার্চুয়াল রিয়েলিটি যে এই জগৎকে পাল্টে দেবে সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আমরা ইতোধ্যেই থ্রি-ডি গেম এবং সিনেমার স্বাদ পেয়ে গিয়েছি। ওগুলো মূলত বিশেষ ধরনের চমশা পড়ে অভিজ্ঞতা নিতে হয়। কিন্তু ভার্চুয়াল রিয়েলিটির জন্য পড়তে হয় বিশেষ ধরনের ডিভাইস, যা চোখে লাগিয়ে আপনি উপভোগ করতে পারেন একদম ভিন্ন একটি অভিজ্ঞতা। যদিও জাকারবার্গ বলছেন, ভার্চুয়াল রিয়ালিটির মাধ্যমে মানুষ একজন আরেকজনের সাথে ভিন্ন মাত্রায় যোগাযোগ করবে, আমি মনে করি এটা লেখাপড়া এবং জ্ঞানবিজ্ঞানে বিশাল ভূমিকা রাখবে। দূরশিক্ষণে এটা দারুণ একটি ভূমিকা পালন করতে পারে। আমরা বাংলাদেশে বসেই স্টানফোর্ড কিংবা হার্ভার্ডের একটি ক্লাস উপভোগ করতে পারব। শিক্ষককে নিজের ক্লাসরুমের মতো দেখতে পাব। অন্যান্য ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গ পাব। সেটাই হবে মূলত আসল ভার্চুয়াল ক্লাসরুম।
যেহেতু এই পরিকল্পনা মাত্র ১০ বছরের, তাই এর চ্যালেঞ্জও আছে প্রচুর। প্রথম চ্যালেঞ্জ হলো বিশাল অংকের এই মানুষগুলোকে একটি ছাতার নিচে নিয়ে আসা, যেখানে ৪০০ কোটি মানুষ এখনও ইন্টারনেটের বাইরে। তবে এটা ঠিক, এগুলো একটা সময়ে চলে আসবে। আগামী ১০ বছরের ভেতর হয়তো অনেকটাই হয়ে যাবে। একটি বড় ধরনের আর্থসামাজিক পরিবর্তন প্রয়োজন হবে। পুরো সমাজকে তো আর ভেঙেচুরে এক করে ফেলা যাবে না। অর্থনীতি তার চাকার মতো ঘুরে যাবে। এই নতুন অর্থনীতির বাইরে থাকা মানুষগুলোকে এর ভেতর আনতে পারলে, বিশাল এক নতুন পৃথিবীকে দেখব আমরা।
আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো ভাষা। পৃথিবীতে এখন সাত হাজারের মতো ভাষা আছে। তার ভেতর মাত্র ৫৫টি ভাষা ইন্টারনেটে বিরাজ করে। কিন্তু বিশাল সেই জনসংখ্যার মানুষ তাদের নিজেদের ভাষায় প্রযুক্তি ব্যবহার করতে চাইবে। তাদেরকে যদি ইংরেজি কিংবা বাংলা নয়তো চায়না ভাষা শিখে এই দলে যোগ দিতে হয়, তাহলে অনেক সময় লেগে যাবে।
এই পুরো বিষয়গুলো ঘটবে ২০২৬ সালের মধ্যেই। সেই সময়ের পৃথিবী হবে ভিন্ন। আজ থেকে ১০ বছর পেছনের দিকে যদি তাকাই তাহলে দেখতে পাব, আজকের অনেক কিছুই তখন ছিল না। এমন প্রচুর কম্পিউটিং ক্ষমতা মানুষের হাতে ছিল না। আবার এমন ব্যান্ডউইডথও আমাদের মোবাইলের ভেতর ছিল না। আমরা এই কয়েক বছর আগেই ভাবতে পারতাম না যে, ক্যামেরা ছাড়া ছবি তোলা যাবে। কিন্তু এখন দেখছি, মোবাইল কিংবা ট্যাবে যত ছবি তোলা হয়, ক্যামেরা দিয়ে ততো হয় না। আর এদের ছবির মানও এত ভালো হয়ে গেছে যে, মোবাইলটাই একটা দারুণ ক্যামেরায় পরিণত হয়েছে। পাশাপাশি তারবিহীন ইন্টারনেট এতো সহজলভ্য এবং দ্রুতগতির হয়ে গেছে যে, একটি মোবাইল থেকেই সরাসরি ভিডিও স্ট্রিমিং করা যাচ্ছে। বিশ্বের অনেক দেশেই ফোর-জি চালু হয়েছে। থ্রি-জি বড় একটি ভূখণ্ডে রয়েছে। অল্প কিছু এলাকায় টু-জি এখনও রয়ে গেছে। এগুলো হয়তো আর কয়েক বছরের মধ্যেই এমনিতেই থ্রি-জি নয়তো ফোর-জিতে চলে যেতে হবে। তখন মানুষ যোগাযোগ করবে ভিডিও-এর মাধ্যমে সরাসরি। মানুষ লাইভ করবে সরাসরি। তখন মানুষ টিভি পর্দাটি ব্যবহার করবে বড় স্ক্রিনে নিজেকে দেখার জন্য, প্রিয় মানুষকে দেখার জন্য। প্রথাগত টিভি তখন মুখ থুবড়ে পরবে তাতে কোনোও সন্দেহ নেই। একইভাবে প্রথাগত কনটেন্ট এবং সংবাদেরও মৃত্যু হবে। মানুষ অনেক বেশি নিজেদের মধ্যেই যোগাযোগ করে তথ্য পেয়ে যাবে; বিনোদন পেয়ে যাবে।
বর্তমানে ১৬০ কোটি মানুষ ফেসবুকের আওতায় এসেছে। বাকি সবাই যে ফেসবুকের আওতায় আসবে, সেটা বলা যাবে না। প্রযুক্তি যখন এমন জায়গায় যাবে, তখন অন্য কেউ এসে আরও সুবিধাজনকভাবে ওটাকে ব্যবহার করে ফেলতে পারে। এমনটাই দেখা গেছে বিগত দশকগুলোয়। ২০২৬ সালের এই গ্রহটি কেমন হবে, তা আমরা একটি একটি বছর পার করেই দেখতে পাব। অপেক্ষায় আছি সেই যাত্রার। সূত্র ঃ অনলাইন ।
কোন মন্তব্য নেই: